রাসূল (সাঃ) এর ইসলামী আন্দোলনের কৌশল ও নীতি



মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
রাসূল (সাঃ) এর সমগ্র জীবন আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয়। তাঁর সফল জীন্দেগীর অন্যতম হলো ইসলামকে মানবতার  মুক্তির জন্য পৃথিবীতে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্টিত করা। রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে আল্লাহর নির্দেশে একটি কার্যকর ইসলামী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যার মাধ্যমে মানবতা প্রকৃত মুক্তির দিশা পেয়েছিল। তাই আল্লাহ তা’য়ালা ইসলামী আন্দোলনকে মু’মিনদের জন্য ফরজ করে দিলেন। কুরআনিক ভাষায় ইসলামী আন্দোলনকে বলা হয় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্। আন্দোলন মানে কোন সংগঠিত জনগোষ্ঠীর  বিশেষ উদ্দেশ্যে সম্মিলিত প্রয়াস। আর জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্ বা  ইসলামী আন্দোলন মানে  ইসলামকে মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। দুনিয়ায় যার চূড়ান্ত রূপ  হল আল্লাহর  জমিনে আল্লাহর  দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। রাসূল (সাঃ) সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মদীনায় ও পরবর্তীতে মক্কাতে  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেন। রাসূল (সাঃ) এর তিরোধানের পর খোলাফায়ে রাশেদীনরা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্টার মাধ্যমে অর্ধ জাহান জুড়ে সোনালী যুগের নতুন অধ্যায় রচনা করেন। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলামী আন্দোলেনের চূড়ান্ত রূপ ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের সুফল পেয়েছিল।
রাসূল (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশে কিভাবে একটি বাস্তবমুখী বিজ্ঞান সম্মত মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে কায়েমী স্বার্থবাদীদের মূলোৎপাটন করে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত দাবীদার অনেকের নিকট সুস্পষ্ট নয়। যে কারণে ইসলামের সঠিক স্বরূপ নিয়ে  নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। শত্রুপক্ষ এমন বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে ইসলামের বিরুদ্ধে অপ্রপ্রচারে লিপ্ত হচ্ছে। তাই নিরেট  ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিতজনরা রাসূল (সাঃ)-এর ইসলামী আন্দোলনের  নীতি ও কৌশল  সমূহ হৃদয়াঙ্গম করা জরুরী।

রাসূল (সাঃ) এর ইসলামী আন্দোলনের নীতি

এক. আল্লাহ্র নির্দেশের অনুসরণ- রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবন ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত পরিচালনা করেছেন আল্লাহর নির্দেশনা মাফিক। তাঁর জীবন পরিচালনার মূল চালিকা শক্তি ছিল আল্লাহ্র অহি। “রাসূল (আঃ) নিজ থেকে কোন মনগড়া কথা বলতেন না, যা বলতেন তা অহী দ্বারা প্রাপ্ত হয়ে।” (সূরা-নজম, ৩-৪)। রাসূল (সাঃ)কে  আল্লাহ্ তা’য়ালা সেই মোতাবেক তাঁর সাথীদের জীবন পরিচালনার জন্য নির্দেশ করেছেন- “রাসূল তোমাদের কে যা কিছু প্রদান করেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেন তা থেকে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর।” (হাশর:৭)।
দুই. শাহাদাতে আলানন্নাস- রাসূল (সাঃ) নিজে এবং নিজের সাথীদেরকে শাহাদাতে আলানন্নাস বা বাস্তব সাক্ষী রূপে সমাজের সামনে উপস্থাপন করেছেন। শেষ নবী মুহম্মদ (সাঃ) এর অন্যতম পরিচয় যেমনি দা’য়ী ইলাল্লাহ ছিলেন তেমনি তাঁর অন্যতম প্রধান পরিচয় হলো দাওয়াতের বাস্তব নমুনা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা। “আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষীরূপে। যেমন সাক্ষীরূপে রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফেরাউনের প্রতি।” (মুযাম্মিল: ১৫)। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে  আল্লাহ্ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশ করেছেন। যেমন- “এভাবে আমি তোমাদের একটি উত্তম জাতিরূপে গড়ে তুলেছি- যাতে করে তোমরা গোটা মানবজাতির জন্যে সত্যের সাক্ষ্যদাতা (বাস্তব নমুনা) হতে পার এবং রাসূল (সাঃ) যেন তোমাদের জন্যে সাক্ষ্য হন।” (আল-বাকারা: ১৪৩)।  তিনি আল-আমিন ছিলেন; ছিলেন সমাজসেবক। তিনি আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা এবং আদর্শ সেনাপতিও ছিলেন। তিনি শুধুই নসিহতকারী ছিলেন না বরং তিনি নসিহতের প্রকৃষ্ট জ¦লন্ত উদাহারণ ছিলেন। রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় প্রতিটি যুদ্ধে তিনি প্রধান সেনাপতির নেতৃত্ব দিয়েছেন, খন্দকের যুদ্ধে মাটি খননের কাজ তিনি নিজেই সর্বাগ্রে শুরু করেছেন। তিনিই সবার আগে সালাম দিতেন, যা নসিহত করতেন তা নিজেই আমল করতেন। রাসূল (সাঃ) ছিলেন তাঁর সাহাবীদের জীবন গঠনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
তিন. পরামর্শভিত্তিক কাজ- রাসূল (সাঃ) ইসলামী আন্দোলনসহ জনসম্পৃক্ত প্রায় কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। আল্লাহ্ তা’য়ালা রাসূল (সাঃ)কে সহযোগীদের পরামর্শ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। “নিজেদের যাবতীয় কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে। (আশ শূরা: ৩৮)
উপরোক্ত মূলনীতি গুলো ছিল রাসূল (সাঃ) এর আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। যার বদৌলত এবং আল্লাহর  রহমতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ইসলাম পৃথিবীর বুকে অন্যতম জীবনব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

রাসূল (সাঃ) এর ইসলামী আন্দোলনের কৌশল
রাসূল (সাঃ) ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত মাঞ্জিলে পৌঁছার ক্ষেত্রে নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। সব বাধা মাড়িয়ে ধৈর্য্য, সাহসিকতা ও কৌশলে তিনি সকল বাধা অতিক্রম করেন। দাওয়াত, সত্যের সাক্ষ্য, কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ্, ইক্বামাতে দ্বীন ও আমর বিল মা’রুফ ছিল রাসূল (সাঃ) এর কৌশল প্রক্রিয়ার অন্যতম। যার মাধ্যমে তিনি দ্বীনকে চূড়ান্ত মঞ্জিলে উন্নীত করেন।
ক. দাওয়াত ও তানজিম- মানুষের উপর যে মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে মানুষকে ওয়াকিবহাল করার জন্য আল্লাহ্ তা’য়ালা রাসলকে তাঁর দিকে আহ্বান করার পদ্ধতি নির্দেশ করেছেন, ‘ডাক তোমার রবের দিকে হিকমতের (কৌশলের) সাথে (সূরা নাহাল-১২৫)। তাই রাসূল (সাঃ) ও দাওয়াতকে তাঁর জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করলেন। যে সমাজে যে মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে সে সমাজের মানুষের নিকট প্রথমে তাঁর স্বরূপ বাস্তবে উপস্থাপন করাটা রাসূলদের প্রথম কাজ ছিল। সেকারণে রাসূল (সাঃ) এর জীবনে কথাও কাজের কোন হেরফের হয়নি। মক্কায় তিনি গোপনে কৌশলে দাওয়াত দিলেন। মদীনায় হিজরত করে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকাশ্যে মদীনাবাসীকে দাওয়াত দিলেন। বিভিন্ন দেশের শাসকদেরকে তিনি দূত মারফত ইসলাম গ্রহণ করার দাওয়াত দিলেন। তিনি তাঁর দাওয়াতী মিশন করতে গিয়ে যেখানে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বিতর্ক এড়িয়ে নতুন পথে এগিয়ে গিয়েছেন। শত্রুকে আপন করে নিয়েছেন। তায়েফের প্রান্তরে প্রস্তরের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন তবু তিনি এই জনপদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি।
রাসূল (সাঃ) ইসলামী আদর্শের ঝাণ্ডাবাহী একদল মুজাহীদ তৈরী করলেন, যাদেরকে রাসূল (সাঃ) যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। রাসূল (সাঃ) ছিলেন এদের মূল প্রশিক্ষক। যিনি তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা প্রদান করেন। যারা নিজেদেরকে চূড়ান্তভাবে আল্লাহ্র নিকট সম্পূর্ণ রূপে শোপর্দ করেছিলেন। রাসূল (সাঃ) কাফিরদের সহস্র বাধা মাড়িয়ে ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা ও কৌশলের মাধ্যমে মক্কা ও মদীনাবাসীর নিকট ইসলামের আহ্বান পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং জাহেলি আমানিশার অন্ধকার থেকে প্ররিত্রাণের জন্য ইসলাম তাদের জীবনে এক অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করলে তারা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন।
দুই. আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম- রাসূল (সাঃ) তাঁর পরিচালিত আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। গোপনে বেশ ক’দিন তাঁর আন্দোলনকে সফল করার জন্য চেষ্টা করলেও আরব পৌত্তলিকদের জুলুম-নির্যাতনের কারণে তিনি আল্লাহ্র নির্দেশে হিজরত করেছিলেন এবং সাহাবীদের মধ্যে যারা জীবন-মরণের সম্মুখীন হয়েছিলেন তাদেরকে আবিসিনিয়ায় ও মদীনায় হিজরতের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীতে রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরতের পূর্বেই সাহাবীদের মাধ্যমে মদীনায় ইসলামের আহবান ও আল্লাহর হুকুমাত কায়েমের মিশন শুরু করে দিয়েছিলেন। যে সময়কালে আল্লাহ্র পথে একদল নিবেদিত ও সমাজ পরিচালনার যোগ্য মানুষ তৈরী করেছিলেন, তখনই রাসূল (সাঃ) কে  আল্লাহ্র পথে লড়াইয়ে নির্দেশ দেন- “ফেৎনা দূরীভূত হয়ে দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করতে থাক।” (আল-বাকারা: ১৯৩)। রাসূল (সাঃ) কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় জাগতিক দৃষ্টিতে শক্তি সামর্থ কম থাকলেও  তিনি যুদ্ধের প্রারম্ভেই তাদের ভিতরে কৌশলে ভয় সৃষ্টি করে দিতেন। রাসূল (সাঃ) গুপ্তচরের মাধ্যমে তাদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে যেতেন, যুদ্ধে যাওয়ার পথ পরিবর্তন করতেন। এছাড়াও যুদ্ধ চলা কালীন সময়ে শত্রু শিবিরের সাথে চুক্তি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে বেশীসংখ্যক রান্না করার চুলা খনন করে অনুন জ্বালিয়ে এবং স্বল্পসংখ্যক টয়লেট নির্মাণের মত কৌশল অবলম্বন কর মুসলিম শিবিরে বেশী সংখ্যক উপস্থিতি জানান দেয়ার মত কৌশল অবলম্বন করেন!
রাসূল (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করার সময় মদীনাবাসী তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। ভিন্ন মতাদর্শীরাও মদীনা চুক্তির মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) কে নেতা হিসেবে গ্রহন করলেন। রাসূল (সাঃ) এখান থেকে বদর ও উহুদ যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করলেও তিনি নিজের মাতৃভুমিকে একমূহুর্তেও জন্যও ভূলতে পারেননি। তাই মক্কাতেও ইসলামী ঝান্ডা কায়েমের লক্ষ্যে পরিকল্পিত ভাবে কাজ করতে লাগলেন। তিনি মক্কায় কা’বা তাওয়াফের সিদ্ধান্ত নিলেন। সাহাবীদের নিয়ে তিনি মক্কার দোড় গোড়ায় আসলে কাফিরদের বাধার সম্মুখিন হলেন। আবু সুফিয়ানরা রাসূল (সাঃ)কে এবার হজ¦ করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানালেন। রাসূল (সাঃ) রক্তপাত পছন্দ করলেন না, তিনি এবার হজ্জ না করে ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর সঙ্গি-সাথীদের নিয়ে  হজ¦ করবেন এই শর্তে কাফেরদের সাথে “হুদায়বিয়ার সন্ধি” তে আবদ্ধ হলেন। সাময়িক ভাবে মনে হয়েছিল এই চুক্তির  মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী। তাই হয়রত ওমর (রাঃ) সহ অনেকে এই চুক্তির পর মন খারাপ করেছিলেন।  আল্লাহ তা’য়ালা এই চুক্তিকে ফতহুম মুবিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পরবর্তী বছর রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মক্কায় আগমন করে হজ্জ পালন করলেন এবং বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করলেন। যারা “হুদায়বিয়া সন্ধি”র পর  মনোকষ্ট পেয়েছিলেন তারা ফাতহুম মুবিনের অর্থ মক্কা বিজয়ের পরে বুঝতে পেরেছিলেন। এ থেকে বুঝা যায় রাসূল (সাঃ) কতটা ধৈর্য্য ও কৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতি ইসলামের অনুকূলে নিয়ে আসেন!
তিন. ইক্বামাতে দ্বীন-রাসূল (সাঃ) দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করলেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে পরীক্ষিত যোগ্য লোক তৈরী করলেন এবং ইসলাম বিদ্বেষী মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে ইসলামকে আরব সমাজে একটি কার্যকর শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উপযুক্ততার দ্বারপ্রান্তে উন্নীত করলেন। তখন আল্লাহ্ রাসূল (সাঃ) কে নির্দেশ করলেন-“তোমরা দ্বীনকে কায়েম কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না (সূরা- শুরাঃ ১৩)।  রাসূল (সাঃ) বিদায় হজে¦র ভাষণে ইসলামের পূর্ণতার বিষয়ে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পেলেন- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়মিত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করলাম।” (সূরা মায়েদা-৩)।
চার. আমর বিল মা’রূফ ও নেহী আনিল মুনকার বা সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে বাধাদানের কাজ- রাসূল (সাঃ) যখন দ্বীন কায়েম করলেন তখন সৎকাজের আদেশ প্রদান ও অসৎকাজে বাধা দানের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি এটি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর করেছিলেন। সরকারী প্রশাসনের মাধ্যমে এই কাজের আঞ্জাম পাওয়াটাই শরীয়তের আসল স্পিরিট। যা রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় কায়েম করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আল্লাহর নির্দেশ- “তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও আর অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখ।” (সূরা: আলে ইমরান-১১০)।

রাসূল (সাঃ) ইসলামী  আন্দোলন ও মুসলিম বিশ্ব

যে মতাদর্শ জমিনে প্রতিষ্ঠিত হবে তা মানুষের কাছে প্রচার প্রসার না করে হঠাৎ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এটি ইসলামী আন্দোলনের একটি চলমান প্রকৃয়া। এজন্য প্রয়োজন ইসলামী আন্দোলন বা সংগঠন। যে আন্দোলন মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেবে। প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের পরিবর্তে  সেই সমাজের মানুষের মন মগজে নতুন চিন্তা-চেতনা ও প্রচারিত কৃষ্টি-কালচারকে মনে-প্রাণে জীবনের সর্বক্ষেত্রে  কায়েম করার জন্য বাসনা জাগ্রত হবে। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা তেমনি একটি কার্যকর ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত করেছিলেন।  যার ফলশ্রুতিতে ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যে আন্দোলনটি বিশ্বব্যবস্থায় সে সময়ের চলমান যেকোন মতাদর্শের চাইতে উন্নত ও বাস্তব সম্মত ছিল।  সেই আন্দোলনের ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় একটি প্রত্যাশিত পরিবেশে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিল। যার বাস্তব নমুনা ছিলেন রাসূল (সাঃ) স্বয়ং নিজেই। যেখান থেকে অনাগত ইসলামী ঝাণ্ডাবাহীরা সঠিক নীতি আদর্শ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে। ইসলামী আন্দোলন আমৃত্যু আল্লাহর পথে দায়েম-কায়েম থাকার অন্যতম পথ। কেউ যদি এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাই হবে বাস্তব সম্মত। আর ইসলাম আগমনের উদ্দেশ্যই এটি-  “এই দ্বীন এসেছে তার বিপরীত সমস্ত দ্বীন বা মত ও পথের উপর বিজয়ী হওয়ার জন্যেই।” (আত্ তওবা: ৩৩, আল ফাতহ: ২৮, আস সফ:৯)।
কোন বিপরীত শক্তির উপর বিজয়ী হওয়ার স্বাভাবিক দাবীই হলো একটি সর্বাত্মক আন্দোলন, একটি প্রাণান্তকর সংগ্রাম, একটি সার্বিক বিপ্লবী পদক্ষেপ। এই কারণেই আল কুরআনে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে ঈমানের অনিবার্য দাবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহ্র পথে জিহাদ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যারা ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত বলে দাবী করছেন তারা অনেকে সঠিক পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রত নন। এদের মধ্যে কেউ কেউ খোদাদ্রোহীদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়েছেন, কেউবা খানকা, মাজার ও পীর দরবেশগিরীতে লিপ্ত হয়ে কথিত ইসলাম প্রতিষ্ঠার ফাঁকা বুলি জপছেন। এরা দ্বীনের প্রচার প্রসার ও ইসলাম প্রতিষ্ঠাতো দূরে থাক বরঞ্চ এরা জনমনে সঠিক ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সংশয় অনুপ্রবেশ করতেই মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। আরেকটি দল চাইছে ত্রাস করে জনমনে ভয়ভীতি ছড়িয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবে। যদিওবা এটি রাসুলের দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি নয়। ইদানীং কালে এভাবে সহজ কায়দায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও কেউ কেউ চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা টেকসই হয় না। রাসূল (সাঃ) অসি নয় মসিতেই ইসলামের বিজয় এনেছিলেন। হক্কানী ওলামায়েক্বেরামও ইসলামী হুকুমাতের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে না তুলে এই পদ্ধতিতে  ইসলামী হুকুমাত কায়েমের পক্ষে নন। রাসূল (সাঃ) যুদ্ধের ময়দানেও নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। রাসূল (সাঃ) ইসলামকে একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছেন “তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা মানুষের জন্য সত্যের সাক্ষ্য হতে পারে।” (সূরা বাকারা-১৪৩)। শেষ পদ্ধতিটির উপর যারা প্রতিষ্ঠিত আছেন  তারাও অনকে প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করছেন।
মুসলিম উম্মাহর অনক্যৈর সুযোগে প্রতিনিয়ত সম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী ও খোদাদ্রোহী শক্তিরা বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে মুসলিম নিধনে নেমেছে। মুসলিম শাসক ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দাবীদাররা কৌশলের নামে নিরবতার ফলে  ইসলামের শত্রুরা আরো নব উদ্যমে মুসলমানদের হত্যায় মেতে উঠেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে মূলনীতি, কৌশল ও ঐক্যের প্রয়োজন তা উম্মাহ্র নেতৃত্বরা রাসূল (সাঃ) এর ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃয়া থেকে শিক্ষা গ্রহন করতে পারেনি। যে কারণে উম্মাহ একটি কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করছে।
এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক ভিত্তিক সঠিক ইসলামের প্রচার-প্রসার, যাতে বিরুদ্ধবাদীরা অপপ্রচারের সুযোগ নিতে না পারে। ইসলামী আন্দোলনের নেত্ববৃন্দদেরকে  যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে যারা বিশ্ব নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। যারা প্রয়োজনে জুলুমতন্ত্রের অবসান ঘটাতে সংগ্রামে লিপ্ত হবে। এই স্বাভাবিক প্রকৃয়ার মাধ্যমে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হলে তা হবে টেকসই। যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার সুনিশ্চিত হবে। যে ইসলামী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় সমাজে আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সাময়িক পরাজয়ে হতাশ হয়ে গেলে চলবে না। ধৈর্য্য ও সাহসিকতা নিয়ে অবিরাম ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তবে একগুঁয়েমীতে নিমজ্জিত হয়ে  নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে ইসলামী চেতনার ক্ষতি ডেকে আনা যাবে না। ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী রাসূল (সাঃ) আন্দোলনের পদ্ধতি অনুস্বরণ করে আল্লাহ্র সাহায্যেও প্রত্যাশী হয়ে অবিরত সম্মুখে এগিয়ে গেলে দ্বীনের বিজয় কেতন মুসলমানরা পুনরায় উড্ডীন করতে পারবে, ইনশাল্লাহ্!
রাসূল (সাঃ) এর ইসলামী আন্দোলনের কৌশল ও নীতি রাসূল (সাঃ) এর ইসলামী আন্দোলনের কৌশল ও নীতি Reviewed by কুঁড়েঘর on 1:16 PM Rating: 5

No comments

Thank's